ফরাসি নব তরঙ্গের (ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ) সময় ‘অতঁর থিওরি’ নামে একটি তত্ত্ব বিশ্ব সিনেমায় বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। এই তত্ত্বমতে, একটি উপন্যাস যেমন একজন লেখকের নিজ ধ্যানধারণার ফসল, তেমনি একজন পরিচালক হলেন তাঁর চলচ্চিত্রের সর্বেসর্বা। অতঁর পরিচালকের চলচ্চিত্রে গল্প, তা বলার ঢং, চরিত্রগুলোর মনোজগতের বিশ্লেষণ, গল্পের গাঁথুনি এবং ঘটনা বিশ্লেষণে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ থাকে প্রবল। এ ছাড়া অতঁর সিনেমা-তত্ত্বে চলচ্চিত্রকে বাস্তবের খুব কাছাকাছি উপস্থাপনের ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছিল।
কাঠবিড়ালী চলচ্চিত্রটির সেন্সর সনদপত্রে আবেদনকারী, প্রযোজক ও পরিচালক—তিন জায়গাতেই নিয়ামুল মুক্তার নাম দেখে আমার অতঁর সূত্রের কথা মনে পড়ে। পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলীদের সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে চলচ্চিত্রটি নির্মিত। প্রযোজক নিয়ামুল মুক্তার প্রচেষ্টাকে সুগম করতে আরও অনেকেই যে এগিয়ে এসেছিলেন, তা ‘বিশেষ কৃতজ্ঞতা’র নামের বহর দেখে বোঝা যায়। আমি এ বিষয়টি নিয়ে খানিকটা আলাপ করছি, কেননা নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাজের ধরন বিশ্লেষণ করতে গেলে এই ছবির প্রযোজনার ধরন দৃষ্টান্ত হিসেবে আসবে। এই ছবির ক্ষেত্রে পরিচালক নিজেই যেহেতু সব দায়িত্ব নিয়েছেন, কাজেই প্রযোজক হিসেবে এর সফলতা বা ব্যর্থতার যাবতীয় দায়ও নিয়ামুল মুক্তার।
একজন তরুণ পরিচালক হিসেবে অন্যদের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের গল্পের ওপর আস্থা রেখে এবং নিজের ঢঙে তা বলার সাহস দেখিয়েছেন নিয়ামুল মুক্তা। তিনি কাজটি ঠিক সময়ে শেষ করে সিনেমা হলে নিয়ে আসা পর্যন্ত যে মানসিক শক্তি ধরে রেখেছিলেন, এ জন্য দাঁড়িয়ে একটি হাততালি পাবেন। নিজের সক্ষমতা বিচার করে কোন গল্পটা বাছাই করলে, কাদের শিল্পী বা কলাকুশলী হিসেবে নিলে, কিংবা কোথায় শুটিং করলে ছবি শেষ করা যাবে, এ বিষয়টি বুঝতে পারা এবং এসব কীভাবে হবে, কী করে হবে—এ রকম নানান ভাবনা ভাবতে থাকা নির্মাতাদের জন্য ২০২০ সালের শুরুতেই কাটবিড়ালী একটি সাহসী উদাহরণ।
যা দেখা যায় এই সিনেমায়
চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের একটি গ্রাম, যেখানে চরিত্রগুলো কেউই আদতে নতুন নয়। আমাদের সাহিত্যে বা সিনেমায় সচরাচর সরলের সঙ্গে শঠের, ভালোবাসার সঙ্গে কামনার, ক্ষমার সঙ্গে প্রতিশোধের যে ধরনের দ্বন্দ্ব দেখা যায়, সেটারই একটি ‘নিয়ামুল মুক্তা সংস্করণ’ দেখি আমরা এই ছবিতে।
কাজলের (অর্চিতা স্পর্শিয়া) প্রেমে হাবুডুবু খায় গ্রামের সহজ-সরল ছেলে হাসু (আসাদুজ্জামান আবীর)। প্রেম-ভালোবাসায় মশগুল সহজ-সরল রোমিওকে জীবনের নানা জটিলতা ও বাস্তবতা নিয়ে জ্ঞান দেয় তার বন্ধু আনিস (শাওন)। অন্যদিকে বাংলাদেশের অনেক প্রেমের গল্পের মতোই গরিব ঘরের সুন্দরী প্রেমিকার দিকে নজর যায় এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানের। গ্রামের চেয়ারম্যানের (হিন্দোল রায়) ছেলে আসগর (সজীব) সে রকম একটি চরিত্র। কাজলকে বিয়ে করতে চায় সে। কাজলের মাকে (শিল্পী সরকার অপু) নানা ধরনের হুমকি দেয়। কাজলের মতো একটি অতি সুন্দর মেয়েকে নিয়ে এ ধরনের জটিলতা হবে, বখাটে পথ আটকে হুমকি দেবে—এটাই বাংলা সিনেমার চিত্রনাট্যে খুব স্বাভাবিক। তার চেয়ে বেশি স্বাভাবিক, নায়ক যতই বোকাসোকা, উদাসীন বা অবৈষয়িক হোক না কেন, ওকেই নায়িকা ভালোবাসবে এবং শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গেই থাকতে চাইবে। কাজল ও হাসুর ক্ষেত্রেও তা–ই হয়। সিনেমার প্রথম ভাগে তেমন কোনো কাঠখড় না পুড়িয়েই বিয়ে হয় হাসু ও কাজলের। কিন্তু বাংলাদেশের অন্য সরল প্রেমের সিনেমার সঙ্গে কাঠবিড়ালীর এখানেই পার্থক্য। এখানে কাঠ ও খড় উভয়ই পুড়েছে বিয়ের পর। দাম্পত্য জীবনে কামনার সঙ্গে ভালোবাসার দ্বন্দ্ব, দায়িত্ববান স্বামী বনাম উদাস প্রেমিক, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বনাম এর পরিণতি এবং একজনের পাপের প্রায়শ্চিত্তে অন্যজনের শাস্তি ভোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে আধুনিক প্রেমের ছোঁয়া কী ধরনের রং-রূপ-আকার নিতে পারে, তা দেখা গেছে।
আধুনিক গ্রামে সম্পর্কের ট্র্যাজেডি
কাঠবিড়ালীকে আমরা ‘আধুনিক গ্রামে সম্পর্কের ট্র্যাজেডি’ বলতে পারি। কেননা এই ছবিতে প্রেম সফলতা পেয়েছে। কিন্তু সেই ভালোবাসা বৈষয়িক, মানসিক, দৈহিক ও অর্থনীতিক চাপে পিষ্ট হয়ে এক বিশ্রী পর্যায়ে চলে যায়। এই ছবি আজ থেকে ২০ বছর আগে আমাদের বর্ণনায় বিশ্বাসযোগ্য হতো না। কেননা তখন হয়তো এর চেয়ে জটিল কোনো গল্প এবং এর পরিণতি বাস্তবে ঘটলেও আমাদের সিনেমায় তা তুলে ধরার জন্য আমরা হয়তো প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের আবহমান প্রেমের সিনেমায় নায়িকারা নায়কদের পেলেই সুখী। কিন্তু কাঠবিড়ালীতে কাজল ভালোবাসার মানুষকে পেলেও নিজের জৈবিক চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়ায় শুরু হয় জটিলতা। ছবি দেখতে দেখতে আমার কাজলের জন্য মায়া হয়েছে। বেচারি আরেকটু স্বাবলম্বী হলে, আরেকটু সাহসী হলে নিজের স্বাভাবিক চাওয়া যা স্বামী পূরণ করতে পারছে না, তার জন্য এত সংকোচে, সংকটে, পাপবোধে জীবন কাটাতে হতো না। ওদের ভালোবাসাটা আরেকটু বন্ধুত্ব আর শ্রদ্ধার খুঁটিতে বাঁধা থাকলে হাসুর বন্ধু আনিস হয়তো এত সহজে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়ত না! সিনেমার প্রথম ভাগে যে আসগরকে আমরা বখাটেপনার জন্য ভিলেন ভাবি, গল্পের শেষে পুলিশের জবানিতে ওর পরিণতির কথা শুনে তার জন্যও মায়া হয়। আর এই ছবির শেষে সব ঘৃণা গিয়ে পড়ে নায়ক হাসুর ওপর। বাংলাদেশের প্রেমের ছবিতে নায়কের জন্য মায়া না হয়ে ঘৃণা জন্মানো, নায়িকার প্রতি সমবেদনা, নায়কের বন্ধুর জন্য একরাশ অভিশাপ আর প্রথম ভাগে পাওয়া ভিলেনের জন্য মায়া—এই নানা অনুভূতিমালার বুনিয়াদে নির্মিত হয়েছে কাঠবিড়ালী; যেটি মুক্তার নিজস্ব ঢঙে বানানো—তাই হয়তো প্রচারে ওরা লিখছে ‘আমাদের সিনেমা’।
বৈশ্বিক মানদণ্ডে এই ছবির গল্প ও নির্মাণের দিক থেকে অনেক খুঁত হয়তো বের করা যাবে। কিন্তু নতুন নির্মাতাদের জন্য তাঁর নির্মাণশৈলী, বুনন ও সিনেমার পুরো কাজ শেষ করাটাই আমার কাছে প্রধানতম একটি বিষয় মনে হয়। একজন ব্যাটসম্যান যেমন অভিষেকের দিনে সেঞ্চুরি না পেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের হাল ধরে অবদান রাখতে পারেন, তেমনি আমাদের এই লগ্নীকারকনির্ভর প্রযোজনা মনস্তত্ত্বের সময়ে কাঠবিড়ালী একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ বলে আমি মনে করি।
সারা বছর মানহীন যেসব ছবি আমাদের এখানে নির্মিত হয়, সেই তুলনায় ও সম্ভাবনার বিচারে কাঠবিড়ালী সমালোচক গুণমান ও বাণিজ্যিক—এই দুই উপাদানেই নির্মিত।
কিছু প্রশংসা
কিছু চরিত্রের অভিনয় খানিকটা খেলো হলেও অর্চিতা স্পর্শিয়া, আসাদুজ্জামান আবীর, শাওন যথেষ্ট ভালো অভিনয় করেছেন। ইমন চৌধুরীর সংগীতায়োজন যথেষ্ট শ্রুতিমধুর। শব্দগ্রাহক হিসেবে বরাবরের মতোই রিপন নাথ বিশ্বাসযোগ্য আবহ তৈরি করেছেন। চিত্রগ্রহণে আদিত্য মনির মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। রাশেদুজ্জামান সোহাগ ও লিয়ন রোজারিওর রংবিন্যাস চোখে প্রশান্তি এনে দিয়েছে। মুহাম্মাদ তাসনিমুল হাসান চিত্রনাট্য ও সংলাপ অংশে ভালো ভূমিকা রেখেছেন। আলাদা করে একজনের কথা বলব, ছবিটি যেহেতু ভালোবাসার গল্প থেকে একসময় খানিকটা থ্রিলারে পরিণত হয়, তাই এর পেছনে সম্পাদক আশিকুর রহমানের প্রচেষ্টাও চোখে পড়ার মতো।
পরিশেষে গল্পের বিষয়বস্তু, চরিত্রের মনোজগৎ ও এদের পরিণতি নিয়ে পরবর্তী সিনেমায় আরও পরিণত গল্প দেখানোর প্রত্যাশা রাখছি নিয়ামুল মুক্তার কাছে। নিজেকে বাংলা সিনেমার একজন অতঁর নির্মাতা হিসেবে আবির্ভূত করার সাহস দেখানোর জন্য মুক্তাকে অভিনন্দন জানাই।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা
আপনার মতামত লিখুন :