আজকের এই দিনেই গ্রেফতার হয় জঙ্গিনেতা বাংলা ভাই। পতন ঘটে জঙ্গি উত্থানের। মুক্তাগাছার দুর্গম পল্লী রামপুর গ্রামের মানুষের মন থেকে এখনও জঙ্গি আতঙ্ক কাটেনি।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার দুল্লা ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের নেওয়াজ আলীর ছেলে চাঁন মিয়ার বাড়ি থেকে ২০০৬ সালের ৬ মার্চ রক্তাক্ত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় জঙ্গিনেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই। একই সঙ্গে গ্রেফতার হয় তার সহযোগী জঙ্গি মাসুম।
তার আগে ২মার্চ সিলেটের পূর্ব শাপলাবাগের সূর্যদিগল বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান। ময়মনসিংহ শহরের আকুয়া রামকৃষ্ণ মিশন রোডের একটি বাসা থেকে আটক করা হয় তার স্ত্রী ফাহিমা, ১৮ মাসের শিশুপুত্র সাদবিন সিদ্দিক ও জেএমবির এহসার সদস্য ইয়াজকে। ফাহিমার স্বীকারোক্তি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান কর্নেল গুলজার আহমদের নেতৃত্বে একটি টিম ২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অীভযানে বাংলাভাইকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
মূলত, বাংলাভাইয়ের গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই তছনছ হয়ে যায় জেএমবির জঙ্গি নেটওয়ার্ক। বাংলাভাই গ্রেফতারের পর অবহেলিত গ্রাম রামপুরকে নিয়ে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। সাংবাদিক, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সচেতন মানুষের নজর ছিল এ গ্রামের দিকে। জঙ্গিরা কোথায় থেকে কিভাবে আসতো-যেতো কোথায় চলতো ট্রেনিং, এ অঞ্চলে কী পরিমাণ জঙ্গি রয়েছে তা নিয়ে চলত হিসাব-নিকাশ। ক্রমশ বেরিয়ে আসতে শুরু করল নানা চমকপ্রদ অজানা তথ্য।
জানা গেছে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলার মূল পরিকল্পনা করা হয়। একই বছরের জুন মাসে মুক্তাগাছার আরেক অবহেলিত গ্রাম সৈয়দ গ্রামের শরিফের বাড়িতে। মুক্তাগাছা ও জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঘোড়াধাপ ইউনিয়নের ঘোড়াধাপ, হরিণাতলা, চিথলিয়া গ্রামকে ঘিরেই দেশে প্রথম জঙ্গি ঘাঁটি আত্ম প্রকাশ ঘটে ১৯৯৮ সালে। সেখানে দুর্গম এলাকায় জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে কার্যক্রম শুরু হলেও পরবর্তীতে যোগদেয় সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই।
জানা যায়, গ্রেফতারের বছর দুয়েক আগে রামপুরের পার্শ্ববর্তী ইছাখালী বাজারে স্থানীয় নাট্যকর্মীরা নাটক করতে চাইলেও জঙ্গিরা বোমা মেরে পুরো গ্রাম উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। যে কারণে ওই সময় আর নাটক মঞ্চস্থ করতে পারেনি। রামপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী এলাকা চ-িম-প, গয়েশপুর, রামাকানা, বদ্রের বাইদ, নালীখালী, শোলাকুড়ি, গোলাবাড়ী, চতল ও চিথলিয়ার বিভিন্ন স্পটে জঙ্গি বাহিনীর ছিল অবাধে বিচরণ। কামান্ডো স্টাইলে নিঝুম অন্ধকারে চলত ট্রেনিং। তখনো কেউ জানতে পারেনি এরা কারা? একপর্যায়ে ওই এলাকাগুলো হয়ে ওঠে জেএমবির নিরাপদ ঘাঁটি।
৬ মার্চ ভোররাতে তৎকালীন র্যাবের কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহম্মেদ (বিডিআর বিদ্রোহে পিলখানায় নিহত) নিভৃত পল্লীর রামপুরে একদল সাহসী অফিসার ও সৈনিক নিয়ে নেওয়াজ আলীর ছেলে চান মিয়ার টিনশেড বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলেন। তারপর চালানো হয় অপারেশন। মাত্র ২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অপারেশনে বাংলাভাই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক থাকায় ভ্যানযোগে এনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে হেলিকপটারে তাকে ঢাকায় নেয়া হয়। স্যাটেলাইট চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা ছুটে যান ঘটনাস্থলে। দ্রুত দেশব্যাপী প্রচার পায় জেএমবির শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইয়ের গ্রেফতারের খবর। যে বাংলাভাইকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় গ্রেফতারের জন্য চারদলীয় জোট সরকার ঘোষণা করেছিল ৫০ লাখ টাকা, যে বাংলাভাইকে নিয়ে গোটা বাংলাদেশ ছিল আতঙ্কিত, সেই বাংলাভাইকে জীবিত গ্রেফতার খবরে গোটাজাতি স্বস্তির নিঃশাস ফেলে।
২০০৭ সালে ২৯ মার্চ জিএববির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, মোস্টওয়ান্টেড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ অপরাপর ৬ জেএমবির ফাঁসি দেশের বিভিন্ন জেলখানায় কার্যকর হয়।
বর্তমানে মুক্তাগাছায় কোন জঙ্গি তৎপরতা নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে র্যাবের হাতে জঙ্গি আটকের খবরে প্রায়ই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এলাকার জনগণ।
আপনার মতামত লিখুন :