কাজের সন্ধানে শহরে ছুটছে হাওরবাসী


Tajul প্রকাশের সময় : মে ১০, ২০১৭, ৪:৩৩ PM / ৬২
কাজের সন্ধানে শহরে ছুটছে হাওরবাসী

উজান থেকে নেমে আসা পানিতে অকাল বন্যায় নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে একমাত্র বোরো ফসল। হাওর এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্যের অভাব। একদিকে খাদ্যের অভাব, অন্যদিকে ঋণের চাপ। দিশেহারা হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কাজের সন্ধানে পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটছেন শহরের দিকে। হাওরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও দিনদিন কমে যাচ্ছে। ত্রাণের কথা শুনলেই নদীর পাড়ে ভিড় জমায় অসহায় নারী পুরুষ ও শিশু। হাওর এলাকায় অসময়ে পানি চলে আসায় ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে জেলার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন, মদন, মোহনগঞ্জ ও কলমাকান্দাসহ বিভিন্ন উপজেলায় বোরো ফসল তলিয়ে গেছে।
সরকারিভাবে ওএমএস, ভিজিডি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। যার ফলসূতিতে উপজেলায় দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। রয়েছে এনজিও ও মহাজনি ঋণের চাপ। সরকারি নিষেধাজ্ঞা মানছেন না এনজিও কর্মীরা। তারা ঋণের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ওপর। ঋণের চাপে অনেক পরিবার এখন গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিচ্ছে। মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও মদন উপজেলার একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, মহাজনের ঋণ ও এনজিওর কিস্তির চাপে ত্রাণের আশা ছেড়ে বিভিন্ন গ্রাম থেকে কিছু পরিবার শহরের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে।
বাড়ি ভিটা ছেড়ে যাওয়া এমন একাধিক পরিবারের সদস্যরা জানান, তাদের ওপর ঋণের চাপ আছে। কাজ না করলে ঋণ দিবে কি করে। কাজের সন্ধ্যানে তারা শহরে দিকে যাচ্ছেন। ত্রাণের কথা শুনলে কিংবা বাইরে থেকে কোন নৌকা গেলেই নদীর পাড়ে ভিড় করেন অসহায় নারী, শিশু ও পুরুষ। এদিকে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ঘুরে দেখা গেছে জেলার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ থেকে ২০জন শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে বাবা মায়ের সঙ্গে গ্রাম ছেড়েছে। যাও উপস্থিত আছে এদের অধিকাংশ প্রথম সাময়িক পরীক্ষার জন্য। কারো কারো বাবা মা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। কেউ উপবৃত্তির টাকা বাতিলের ভয়ে রয়ে গেছে। তবে পরীক্ষা শেষ হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো কমে যাবে বলে শিক্ষকরা জানান। কেউ কেউ পরীক্ষা দিতে ত্রসে কান্নাকাটি করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাবা মা আত্মীয় স্বজনের কাছে রেখে যাওয়ায় কান্নাকাটি করছে তারা।

প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় এমন চিত্র ছিল মোহনগঞ্জ উপজেলার বরান্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন জানান, প্রথম শ্রেণিতে ৬২ জনের মধ্যে ৪৭ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৬৪ জনের মধ্যে ৪৬ জন অনুপস্থিত আছে। গাগলাজুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বঙ্কিম চন্দ্র পাল জানান, স্কুল খুলেছেন কদিন হল। প্রথম শ্রেণিতে ৬৯ জনের মধ্যে ৩৯ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩৭ জনে ১৪ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩৯ জনে ২৯ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৩২ জনে ১২ জন ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৪১ জনে ১৫ জন অনুপস্থিত আছে। মল্লিকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম খান জানান, প্রথম শ্রেণিতে ২৩ জনে সাতজন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২২ জনে পাঁচজন, পঞ্চম শ্রেণিতে ১৪ জনে ১৩ জন অনুপস্থিত। খালিয়াজুরী উপজেলার পূর্ব জগন্নাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিকে ৩০ জনে সাতজন অনুপস্থিত, প্রথম শ্রেণিতে ৯১ জনে ২৯ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৯৭ জনে ১৩জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৫০ জনে ৯ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৫০ জনে সাতজন ও পঞ্চম শ্রেণিতে ছয়জন অনুপস্থিত।
কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কল্যাণপুর গ্রামের ফাতেমা ইসলাম বলেন, ‘প্রতি মঙ্গলবার গ্রামীণ ব্যাংকের আইয়ুব খান ও ব্রাক ব্যাংকের সোহেল রানা কিস্তি নিতে আসে। হেগোরে কইছি সরকার নিষেধ করছে আপনারা আসেন কেন? তারা বলে উপরের অর্ডার না আসলে আমরা কি করবো।’ এ ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংকের ফিল্ড অফিসার মো. আইয়ুব আলী বলেন, আমরা এলাকায় যাচ্ছি, যারা স্বেচ্ছায় কিস্তি দিচ্ছে তাদেরটা নিচ্ছি। জোরাজুরি করছি এ কথা কেউ বলতে পারবে না।

খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কল্যাণপুর গ্রামের মসজিদ পাড়া এলাকার আবুল মিয়া ’ কাদঁতে কাঁদতে এসব কথা বলেন ‘মন চায় গলায় ফাঁস দিয়া মইরা যাই। ব্র্যাক সমিতি থ্যাইক্কা লোন নিছলাম, কৃষি ব্যাংকের লোন, আছে গ্রামের মহাজনের দেড়গুণ সুদের ট্যাহা। প্রতি মঙ্গলবার কিস্তির নিতে এনজিওর লোক আইয়া বইয়া থাহে। হেগোরে কইছি আমারে জেল নেইন, নাইলে বাড়ি বেইচ্যা নেইনগা। মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার তেতুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মুরাদ, মাঘান সিয়াধার ইউপি চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক ও খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. নাজিম উদ্দিন সরকার বলেন, তাদের ইউনিয়ন থেকে প্রায় শতাধিক পরিবার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।
খালিয়াজুরী ইউএনও মোহাম্মদ তোফায়েল আহমেদ ও মোহনগঞ্জের ইউএনও মো. নিজাম উদ্দিন উভয়েই বলেন, এনজিওদের মিটিং করে জানিয়ে দিয়েছেন। তার পরও যদি কেউ কিস্তির টাকার জন্য চাপ দেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইউপি চেয়ারম্যানদের বিষয়টি দেখার জন্য বলা হয়েছে।