এ যেন অপূর্ব এক প্রতিশোধ। একজন প্রতিযোগীর কাছে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারেনা। গতকাল (মঙ্গলবার) চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক আব্দুল জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সেই বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ভাসছিলেন রামুর দিদার বলী। গতবছরের ফাইনালে ৩১ মিনিটের অসমাপ্ত লড়াইয়ে রেফারিদের দৃষ্টিতে চ্যাম্পিয়ন উখিয়ার শামসু বলীর কাছে শিরোপা হারান দিদার বলী। এবারে সেই শামসু বলীকে লড়াইয়েই হারিয়ে শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন রামুর দিদার বলী। গতকাল লালদিঘি মাঠে রবি’র পৃষ্টপোষকতায় অনুষ্ঠিত চ্যালেঞ্জ বাউটে ১৬ মিনিটেই কুপোকাত হন শামসু বলী।
এই বলী খেলাতে দিদার বলীর রয়েছে গৌরবময় এক ইতিহাস। এবারসহ ১৫ বছরের পদচারনায় সবমিলিয়ে ১১ বার শিরোপা জেতেন দিদার বলী। এরমধ্যে ৭বার এককভাবে এবং ৪ বার মর্ম সিং ত্রিপুরার সাথে যুগ্মভাবে, একবার হন রানার্স আপ।
তবে এরমধ্যে তার বিষাদময় অধ্যায়ও গেছে কয়েকটা বছর। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিন বছর বহিষ্কার ছিলেন। আয়োজকদের মতে, মর্ম সিং ত্রিপুরার সাথে ইচ্ছে করেই যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দিদার বলীকে এই শাস্তি ভোগ করতে হয়।
এদিকে গতকাল ফাইনালে হেরে যাওয়া উখিয়ার শামসু বলীও রেফারির সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ঠু হতে পারেননি। খেলা শেষে তার বডি ল্যাংগুয়েজে সে রকম ব্যাখ্যাই ফুটে উঠে। গতকাল চ্যালেঞ্জ বাউটের ২টি সেমিফাইনালে দিদার ২২ সেকেন্ডে মিরসরাইয়ের লিয়াকতকে ও শামসু দুই মিনিটেরও কম সময়ে কুমিল্লার রাশেদকে পরাজিত করে ফাইনালে উঠেন।
ঠিক ১২ দিন আগে শিরীষতলায় সাহাবুুদ্দিনের বলী খেলায় ঐ শামসু বলীকে হারিয়েই শিরোপা জিতেছিলেন দিদার বলী। তাতে চরমভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন দিদার বলী। গতকাল আব্দুল জব্বারের বলী খেলার ফাইনালের শুরু থেকেই দিদার বলী প্রতিপক্ষ শামসু বলী’র উপর চাপিয়ে খেলতে থাকেন। তবে দুজনেই অনেকটা সমানে-সমানে লড়ে যাচ্ছিলেন। দিদার শক্তি প্রয়োগ করে খেললেও অনেকটা কৌশলী ছিলেন শামসু। এরমধ্যে দু’বার উপর থেকে শামসু বলীকে আছরে ফেলে দেন দিদার বলী। কিন্তু দু’ বারই নিজেকে সামলে নেন শামসু বলী । কোনভাবেই তিনি মাটিতে পিঠ লাগতে দেননি। কিন্তু তৃতীয় দফায় আর পেরে ওঠেননি তিনি। চিরচেনা ভঙ্গিমায় শামসু বলীকে পেছন থেকে ফেলে দেন দিদার বলী । এতেই শামসু বলীর পিঠ মাটিতে ঠেকে গেলে দিদার বলী চ্যাম্পিয়ন হয়ে যান।
এছাড়া সাধারণ বাউটে ৩১ জন বলী প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেন। এরা হলেন, ভোলার মো সজীব, চকরিয়ার জীবন বলী, মহেশখালীর দিদারুল ইসলাম, মো. হোসেন, নজরল বলী, বাদশা, মো. হাশেম, শাহাবুদ্দিন, রমজান, আনোয়ার ও সৈয়দ নুর, নগরীর আছদগঞ্জের মো. হাশেম, আগ্রাবাদের রবীন, ঘাসিয়াপাড়ার বাবলু, এয়াকুব নগরের যুবরাজ, পাথরঘাটার রাজন, কাটগড়ের মোক্তার, ফিরিঙ্গী বাজারের সান্টু দাশ ও বদরপাতির মো. বাসেত, ফটিকছড়ির রিয়াজউদ্দিন, বাঁশখালীর মো. আক্কাস, উখিয়ার কলিমুল্লাহ ও জয়নাল আবেদিন, কুমিল্লার মো. আলম, রাঙ্গামাটির রুহুল হোসেন, রামুর আব্দুল নুর, রাউজানের মো. সাইফুদ্দিন, কক্সবাজারের সাকিব, সাতকানিয়ার রুবেল এবং ডুলাহাজারা’র জসিমউদ্দিন। এছাড়া দুই বয়স্ক বলী হাটহাজারীর মো. মফিজ ও মিরসরাইয়ের বদিউল আলমের লড়াই ড্র হয়।
প্রতিযোগিতা শেষে সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছিরউদ্দিন বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। এতে চ্যাম্পিয়ন দিদার বলীকে ট্রফিসহ নগদ ২০ হাজার এবং রানার্স আপ শামসু বলীকে ট্রফিসহ নগদ ১৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। এছাড়া, সেমিফাইনালে পরাজিত ২ জন বলীসহ সাধারণ বাউটের বিজয়ীদের মেডেলসহ প্রত্যেককে নগদ ১ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়। এর আগে এ প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মাসুদুল হাসান। প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন স্পন্সর রবি আজিয়াটা লিমিটেডের ক্লাস্টার মার্কেট ডিরেক্টর নাজির আহমেদ। আব্দুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি জহরলাল হাজারী’র সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শওকত আনোয়ার বাদলের সার্বিক তত্ত্বাবধানে উপস্থিত ছিলেন রবি’র চট্টগ্রাম আঞ্চলিক প্রধান আশরাফুল কবির, ডিএসএম কোতোয়ালী নাজমুল করিম ও বরি’র আরটিএম রাহিমুল আনমসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। খেলায় প্রধান রেফারি ছিলেন সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল মালেক, সহকারী ছিলেন নুর মোহাম্মদ লেদু ও মো. জাহাঙ্গীর আলম। উল্লেখ্য, ঐতিহ্যবাহী এই বলী খেলার ১০৯তম আসরে ১০২ জন বলী নাম এন্ট্রি করেন। এরমধ্যে থেকে ৭০ জনকে খেলার অনুমতি দেয়া হয়।
আব্দুল জব্বারের আবক্ষ মূর্তি :
গতকাল ঐতিহাসিক আব্দুল জব্বারের বলী খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামে কোন এক স্থানে মরহুম আব্দুল জব্বারের আবক্ষ মূর্তি গড়ে তোলার ঘোষণা দেন প্রধান অতিথি সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। তিনি বলেন, উনি আমাদের অহংকার, চট্টগ্রামের গর্ব। বলী খেলার মাধ্যমে তিনি এ দেশে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাকে আমরা সম্মানিত করতে চাই। এভাবে বলেই তিনি আব্দুল জব্বারের আবক্ষ মূর্তি স্থাপনের ঘোষণা দেন। তবে এটা কোথায় হবে তা পরে ঠিক করা হবে বলে উল্লেখ করেন।
দিদারের সাথে খেলার আগ্রহ :
তার নাম হাসান আব্দুল্লাহ রুবেল। এন মোহাম্মদ প্লাস্টিকের ঢাকা ফকিরাপুল শাখায় তিনি কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত আছেন। গতকাল আব্দুল জব্বারের বলী খেলায় খেলতে আসা এক যুবক নিজেকে এভাবেই পরিচয় দেন। তিনি সাধারণ বাউটে একজনকে হারিয়ে ১ হাজার টাকায় পুরস্কৃত হন। তিনি বললেন এ নিয়ে তিনি পরপর ৬ বার সাধারণ বাউটে জয়ী হন। তিনি এর আগেও কয়েকবার দিদার বলীর সাথে লড়াই করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। গতকালও ছিল তার একই বক্তব্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তার কথা আয়োজকদের কেউ আমলে আনেন নি। এখন কথা হচ্ছে, ঐ দিদার বা শামসু বলীর সাথে খেলতে হলে কি যোগ্যতা থাকতে হবে। গতকাল দিদার সেমিফাইনালে ২২ সেকেন্ডে’র লড়াইয়ে মিরসরাইয়ের লিয়াকতকে হারান। রুবেল খেললে হয়তো ব্যাপারটা অন্যরকম হতে পারতো। এ ব্যাপারে আয়োজকদের মনোযোগী হওয়ার বিষয়টি অনেকেই উল্লেখ করেন।
আপনার মতামত লিখুন :