মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে দেশটির সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে রোহিঙ্গাদের দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে সীমান্তবর্তী এলাকার বাংলাদেশিদের মধ্যে।
সোমবার মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ৪০ সদস্যের একটি দল ঘুমধুম সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া হয়ে তুমব্রুর দিকে মহড়া দেয়। তারা গুলিবর্ষণ করে বলে নিশ্চিত করেন তুমব্রু উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল হক। তিনি জানান, এসময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হওয়ায় স্কুল ছুটি দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর মিয়ানমারের আকাশে হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায়। এর আগে রোববারও দুই বার মিয়ানমারের আকাশে হেলিকপ্টার দেখা যায়।
শনিবার বিকালে সীমান্তে কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ধামনখালী এলাকায় অনুপ্রবেশ চেষ্টার অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মিয়নমারের ঢেঁকিবুনিয়া এলাকার দিক থেকে সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনীর ছোঁড়া গুলি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থানীয় বাসিন্দাদের ২টি বসতবাড়িতে এসে লাগায় স্থানীয় লোকজনের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিদিনই থেমে থেমে গোলাগুলির ঘটনা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশিদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে।
রবিবার উখিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকার পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসে প্রেস ব্রিফিংকালে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুলি এসে লাগার বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন। তবে, সরেজমিন উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। আর আতঙ্কিত হওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করেছেন সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারী সত্বেও প্রতিদিনই টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঘটছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা। রোববার মধ্যরাত থেকে সোমবার ভোর রাত পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকালে ২২৪ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও পুলিশ। এসময় অনুপ্রবেশে সহায়তার অভিযোগে উখিয়া থানা পুলিশ এক রোহিঙ্গাসহ ২ দালালকে আটক করেছে।
অন্যদিকে সোমবারও উখিয়ায় ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের শূণ্যরেখার খুব কাছাকাছি কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় অবস্থান নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা। ধামনখালী এলাকার কলেজ শিক্ষার্থী কামরুল ইসলাম বলেন, সোমবার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত ধামনখালী, রহমতের বিল ও আঞ্জুমান পাড়া ও আশপাশে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। তারা অপেক্ষায় আছে সুযোগ বুঝে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য।কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকার সীমান্ত পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে কথা হয় জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য গফুর উদ্দিন বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার থেকে প্রতিদিনই মিয়ানমারের ভেতরে সীমান্ত এলাকায় থেমে থেমে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। এতে আতঙ্কগ্রস্ত হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। সীমান্তের খুবই কাছাকাছি গোলাগুলির ঘটনা ঘটায় স্থানীয়রা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। কখন গোলাগুলির ঘটনা ঘটতে পারে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। হঠাৎ করে দিন-রাতের যে কোন সময় শুরু হয়ে যায় গোলাগুলি। তবে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং ভোর রাতের দিকেই বিশেষত ঘটনাগুলো ঘটছে বেশি।
শনিবার বিকেলে মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়ার দিক থেকে ছোঁড়া গুলি সীমান্তবর্তী ধামনখালী এলাকার দুটি বাড়িতে এসে লাগায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানান পালংখালী ইউনিয়নের ধামনখালী এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী মো. আব্দুল মান্নান। ধামনখালী এলাকার মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে ছৈয়দুল হকের (৭০) বাড়ীর মাটির তৈরি দেয়ালে এবং স্থানীয় আরেক বাসিন্দা আবুল হোসেনের বাড়ির টিনের চালে গুলি এসে লাগে বলে জানান তিনি। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। তিনি বলেন, এ ঘটনার পর থেকে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পাশাপাশি স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীরাও কাজ করছেন আতঙ্ক নিয়ে। এতে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে স্থানীয়দের মাঝে।
ধামনখালীতে সীমান্তের খুব কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত ছৈয়দুল হকের বাড়িতে রোববার গিয়ে দেখা মেলে, বারান্দায় ভেতরের দেয়ালে চারটি জায়গায় নতুন করে লেপন করে দেয়ার চিহ্ন। গৃহকর্তা ছৈয়দুল হকের ছেলে ফিরোজ মিয়া (৪৫) বলেন, ‘গত শনিবার বিকেলে ধামনখালী সীমান্তের ওপাড়ে মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়ার দিক থেকে ছোঁড়া গুলি এসে লাগার চিহ্ন এটি। গুলি দেয়াল ভেদ করে বের হতে পারেনি। গুলির আঘাতে মাটি খসে পড়ায় দেয়ালের চারটি স্থানে নতুন করে লেপন করা হয়েছে। গুলিগুলো দেয়ালের ভেতরে রয়েছে। ফিরোজ মিয়ার স্ত্রী পারভীন আক্তার বলেন, ‘ঘটনার দিন বিকেলে বাড়ির ভেতরে পরিবারের অন্যদের নিয়ে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখছিলাম। হঠাৎ করে শুনতে পাই শোঁ-শোঁ শব্দ। বাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে পাই, বাইরে ভিটের বাগানের গাছগুলোতে বৃষ্টির মতো কিছু এসে পড়লো। এভাবে থেমে থেমে দু‘য়েক মিনিট চলার পর এক পর্যায়ে বন্ধ হয়। শোঁ-শোঁ শব্দ বন্ধ হলেও দেখতে পাই বারান্দার ভেতরের দেয়ালে চারটি স্থানে গুলি লেগে মাটি খসে পড়ার চিহ্ন। গুলি লাগার সময় পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে টিভির অনুষ্ঠান দেখতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুলি এসে পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মঞ্জুরুল হাসান খান। তিনি বলেন, সীমান্তের খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টার অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মিয়ানমারের দিক থেকে ইতিপূর্বে কয়েকবার গুলিবর্ষণ করার ঘটনা ঘটেছে। তবে গুলিগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়েনি। মিয়ানমারের দিক থেকে ছোঁড়া গুলি বাংলাদেশের দুই নাগরিকের বাড়িতে এসে লাগার কথা শুনিনি। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির কড়া অবস্থানে থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোন কারণ নেই। বিজিবি টহল জোরদার করার পাশাপাশি ফোর্স বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া যে কোন ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবির সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :