নায়ক রাজ রাজ্জাক যেন এক অমর ‘স্লোগান’। সার্বজনীন অতিথি, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা স্বপ্ননায়ক। কিংবা ‘প্রিয়তমা’র কাঙ্ক্ষিত পুরষ। অনেকের কাছে ‘ঝড়ের পাখি’র মতোই দাপুটে জন। ‘খেলাঘর’ জমিয়ে তোলা মানুষটি। হয়তো ‘অবাক পৃথিবী’র ‘রংবাজ’; হাতে যার ‘আলোর মিছিল’। জজসাহেব’র রায় যে আজ তার জন্যই। কোন ছবির নামের বুননে বাঁধবেন তাঁরে। আজ তিনি সব শৃংঙ্খলের উর্ধ্বে।
চলচ্চিত্রের রাজত্বপটে যেন নিস্তবদ্ধতা। একরাশ আঁধারে ঢেকে চলে গেলেন নায়করাজ রাজ্জাক, অন্য পাড়ে। হয়তো অন্য কোনও রাজত্বে। বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে দাপুটে ও শক্তিশালী অভিনেতা রাজ্জাক আর বেঁচে নেই। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে এ অভিনেতা রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
এ সময় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন তার দুই ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাট, স্ত্রী লক্ষ্মীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। ইউনাইটেড হাসপাতালের মিডিয়া কর্মকর্তা ডা. শাগুফা আনোয়ার তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
শাগুফা আনোয়ার বলেন, বিকাল সাড়ে পাঁচটায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তখন তার হৃদক্রিয়া বন্ধ ছিল। এরপর আমরা তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।
এই মহান অভিনেতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ।
চার অক্ষরে লেখা হলেও রাজ্জাক নামের অধ্যায় যেন ব্যাখ্যাতীত। বাংলা চলচ্চিত্রকে অন্যন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এ মানুষটির জন্ম পশ্চিমবঙ্গের (বর্তমান ভারতের) কলকাতার টালিগঞ্জে । নায়করাজ রাজ্জাক নামে সুপরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিল আব্দুর রাজ্জাক। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বরসতী পূজা চলাকালীন সময়ে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য তার গেম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিদ্রোহীতে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়ক রাজের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা।
তিনি ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান। প্রথমদিকে রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে “ঘরোয়া” নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি আব্দুল জব্বার খানের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের তেরো নাম্বার ফেকু অস্তাগড় লেন চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তীতে কার বউ, ডাক বাবু, আখেরী স্টেশন-সহ আরও বেশ ক’টি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করে ফেলেন। পরে বেহুলা চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক হিসেবে ঢালিউডে উপস্থিত হন সদর্পে। তিনি প্রায় ৩০০টি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র।
রাজ্জাকের পথ ধরেই তার দুই ছেলে বাপ্পা রাজ ও সম্রাট ফিল্মের নায়ক হয়েছেন। কিন্তু তারা কেউই রাজ্জাকের অতীত সাফল্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি।
১৯৯০ সাল পর্যন্ত বেশ দাপটের সাথেই ঢালিউডে সেরা নায়ক হয়ে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এর মধ্য দিয়েই তিনি অর্জন করেন নায়করাজ রাজ্জাক খেতাব। অর্জন করেন একাধিক সম্মাননা। এছাড়াও, রাজ্জাক জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করছেন।
তার প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি নির্মাণ করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য হলো- আকাঙ্ক্ষা, অনন্ত প্রেম, পাগলা রাজা, বেঈমান, আপনজন, মৌচোর, বদনাম, সত্ ভাই, চাঁপা ডাঙ্গার বৌ, জীনের বাদশা, ঢাকা-৮৬, বাবা কেন চাকর, মরণ নিয়ে খেলা, সন্তান যখন শত্রু, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির প্রভৃতি।
১৯৭২ থেকে ’৮৯ সাল পর্যন্ত রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে—স্লোগান, আমার জন্মভূমি, অতিথি, কে তুমি, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, প্রিয়তমা, পলাতক, ঝড়ের পাখি, খেলাঘর, চোখের জলে, আলোর মিছিল, অবাক পৃথিবী, ভাইবোন, বাঁদী থেকে বেগম, সাধু শয়তান, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, মায়ার বাঁধন, গুণ্ডা, আগুন, মতিমহল, অমর প্রেম, যাদুর বাঁশী, অগ্নিশিখা, বন্ধু, কাপুরুষ, অশিক্ষিত, সখি তুমি কার, নাগিন, আনারকলি, লাইলী মজনু, লালু ভুলু, স্বাক্ষর, দেবর ভাবী, রাম রহিম জন, আদরের বোন, দরবার, সতীনের সংসার প্রভৃতি।
অন্ধ বিশ্বাস, সতীনের সংসার, জজসাহেব, বাবা কেন চাকর, পৃথিবী তোমার আমার, বাবা কেন আসামী, মরণ নিয়ে খেলা, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, বাপ বেটার লড়াই, পিতার আসন, পিতামাতার, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা, ভালোবাসার শেষ নেই, ও হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ।
আপনার মতামত লিখুন :