আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বেশ কয়েকটা ম্যাচে হানা দিয়েঠে বৃষ্টি। এতে কোনো কোনো ম্যাচ মাঠে গড়াতেই পারছে না, আবার কখনও বা অর্ধেকটা ম্যাচ হয়েই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নেহায়েত ভাগ্য ভালো (নাকি খারাপ?) থাকলে খেলা আবার মাঠে গড়াচ্ছে, এরপর বাকিটা বৃষ্টিভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েই মাঠে নামতে হচ্ছে দু’দলের। কিন্তু আসলেই সেটা কি স্রেফ ভাগ্য? নাকি কোনো গাণিতিক হিসেব রয়েছে এর পিছনে? নিশ্চিতভাবেই গাণিতিক হিসেব রয়েছে, থাকতেই হবে। কিন্তু সেই হিসেবটা কিভাবে করা হয়?
বর্তমান বৃষ্টি আইনটাকে বলা হয় ‘ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন’ মেথড, যেটাকে আমরা সংক্ষেপে ‘ডি/এল মেথড’ বলে থাকি। এই আইনের পূর্বে আরো যেসব মেথড চালু ছিলো, এর মধ্যে একটি ছিলো ‘এমপিও মেথড’ বা ‘মোস্ট প্রোডাক্টিভ ওভার’ মেথড। তবে, এই পদ্ধতির বড় গলদ ধরা পড়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনাল ম্যাচে। খেলা বন্ধ হওয়ার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিলো ১৩ বলে ২২ রান, সেখান থেকে পরে ১ বলে ২২ রানের অবাস্তব টার্গেট দেয়া হয়। ফলে এ আইন বাতিল করা ছাড়া উপায় ছিলো না।
এই আইনের পরিবর্তেই তখন আরো একটি আইন প্রবর্তনের প্রয়োজন পড়ে, আর সেই আইনের প্রবক্তা হিসেবেই আসেন বৃটিশ নাগরিক – পরিসংখ্যানবিদ ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ এবং গণিতজ্ঞ টনি লুইস। তবে এবার সমস্যা যেটা হলো, এই আইন রীতিমত দুর্বোধ্য কিছু সমীকরণ মেনে চলে। ফলে এই আইন বুঝে উঠতে পারাটা খুব সহজ কোনো ব্যাপার নয়! এমনকি সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিও নিজের মুখে স্বীকার করেছিলেন, ‘আসলে এই আইনটা আমি খুব একটা ভালো করে বুঝি না!’
তবে এটা বুঝতে যে একেবারে রকেট সায়েন্সের প্রয়োজন, সেটাও কিন্তু নয়! ক্রিকইনফো সম্প্রতি একটা ফিচার ভিডিও রিলিজ করেছে, যেখানে বেশ সহজ এবং পরিষ্কার করেই বুঝিয়ে দিয়েছে ডিএল মেথড।
প্রথমত, বৃষ্টি বা অন্যান্য যেকোনো কারণে যদি ম্যাচের পুরো ৫০ ওভার শেষ করা না যায়, তাহলে সে মুহুর্তে ডিএল মেথড ব্যবহার করা হয়। তবে বলে রাখা ভালো, যদি ম্যাচে কোনো বল গড়ানোরআগেই বৃষ্টির কারণে কার্টেল ওভারের ম্যাচ ঘোষণা করা হয় এবং উভয় পক্ষকেই রিডিউসড ওভার খেলতে দেয়া হয় এবং ম্যাচের মধ্যে আর কোনো ওভার কাটা না লাগে, সেক্ষেত্রে ডিএল মেথড প্রযোজ্য হবেনা। এই মেথড ওয়ানডে এবং টি টুয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যবহার করা হয়, তবে আপাতত এই আলোচনা আমরা সীমাবদ্ধ রাখবো শুধু ওয়ানডে ক্রিকেটের মধ্যেই।
কিন্তু এটা আসলে কীভাবে কাজ করবে? ৫০ ওভারে যদি কোনো দল ৩০০ রান করে, তাহলে প্রতিপক্ষ দলকে ২৫ ওভারে কত টার্গেট চেজ করতে হবে? ৩০০ রানের অর্ধেক রান নিশ্চয়ই, ১৫১?উত্তর হলো, না! এখানেই আসবে বৃষ্টি আইনের মারপ্যাঁচ। চলুন শুরু করা যাক রোলার কোস্টার জার্নি, দেখি কোথায় গিয়ে থামা যায়!
ডিএল মেথডে একটি দলের হাতে রিসোর্স থাকে দুইটিঃ ওভারসংখ্যা এবং উইকেট। মাত্রই একটি সিনারিও বলা হলো, যেখানে এক দল ৫০ ওভার ব্যাটিং করে ৩০০ রান করার পর বৃষ্টি নেমেছে। ফলে প্রতিপক্ষ দলকে এই মুহুর্তে রান তাড়া করতে হবে ২৫ ওভারে, আর যেহেতু ওভার (অর্থাৎ রিসোর্স) কমে গেছে কিছুটা, সুতরাং টার্গেটও কমতেই হবে। সুতরাং নিঃসন্দেহে টার্গেট হতে হবে ৩০০ রানের চেয়ে কম।
কিন্তু সেটা কেন ১৫১ হবে না? কারণ কিছুক্ষণ আগেই বললাম, ওভারের পাশাপাশি উইকেটও আরেকটা রিসোর্স। কার্টেল ওভার হয়ে গেলেও উইকেট কিন্তু প্রতিপক্ষের হাতে দশটাই রয়েছে। সুতরাং প্রতিপক্ষ এদিক থেকে কিছুটা হলেও অ্যাডভান্টেজে আছে, তাঁরা কিছুটা হলেও ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ পাবে।
এখানে আরেকটা জিনিসের প্রতি কিছুটা লক্ষ্য রাখা উচিত, টার্গেট এবং পার স্কোর দুটো কোনোমতেই একই ব্যাপার নয়। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া বনাম বাংলাদেশের ম্যাচটির কথাই ধরা যাক।
এ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সামনে ৫০ ওভারে ১৮৩ রানের টার্গেট ছুঁড়ে দেয় বাংলাদেশ। যদি অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের শুরুতেই বৃষ্টি নামতো এবং অস্ট্রেলিয়াকে ২০ ওভার খেলতে হতো, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট দাঁড়াতো ১০৯। যদিও পুরো ইনিংসের ৬০ শতাংশ ওভার (অর্থাৎ রিসোর্স) নষ্ট হয়ে গিয়েছে, কিন্তু অপর রিসোর্স (অর্থাৎ উইকেট) যেহেতু সবগুলোই রয়েছে এবং এই ২০ ওভারের মধ্যেই ১০ উইকেটের সবগুলোই ব্যবহার করতে পারবে অস্ট্রেলিয়া। এ কারণে অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট ১৮৩ থেকে ৪০ শতাংশ হিসেবে ধার্য না হয়ে হতো ২০ ওভারে ১০৯ রান।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার ২০ ওভার শেষ হয়ে যাওয়ার পর যদি বৃষ্টি নামতো, তাহলে টার্গেট কত হতে পারতো?
এইখানেই আসবে পার স্কোরের ধারণা, যেখানে চেক করা হবে অস্ট্রেলিয়া কতগুলো ওভার খেলেছে এবং কতগুলো উইকেট হারিয়েছে। আর এর উপরই নির্ধারণ করা হবে অস্ট্রেলিয়াকে শেষ পর্যন্ত কত করতে হবে।
ধরা যাক, অস্ট্রেলিয়া ২০ ওভারে তুলতে পেরেছে ১ উইকেটে ৪৮ রান। এখানে ওভার রিসোর্স বাকি রয়েছে আর ৬০ শতাংশ (অর্থাৎ ৩০ ওভার), অন্যদিকে উইকেট রিসোর্স বাকি রয়েছে আরো ৯০ শতাংশ (অর্থাৎ ৯ উইকেট)। এখানে অস্ট্রেলিয়া শুরু করেছিলো ৫০ ওভার ম্যাচ হিসেবে, কিন্তু বৃষ্টির কারণে কার্টেল ওভারে সেটা নিঃসন্দেহে কমে আসবে। ফলে রান রেট এবার নিশ্চিতভাবেই বাড়াতে হবে অস্ট্রেলিয়াকে, আর টার্গেটও সেভাবেই ব্যালান্স করা হবে।
এখন যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে, প্রথম ইনিংস চলাকালেই হঠাৎ বৃষ্টি নেমে গেলো, তখন কি হবে? মূলত তিনটা ব্যাপার বিবেচনায় নেওয়া হবে এমন ক্ষেত্রে।
১. কতগুলো ওভার হারাচ্ছে ইনিংসটি,
২. খেলা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার আগে ব্যাটিংরত দলের অবস্থা, এবং
৩. রিসোর্সের শতাংশ হিসাব।
একটা উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির নিউ জিল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটিকেই। নিউ জিল্যান্ডের ইনিংসটি শুরু হওয়ার পর বৃষ্টি নামার কারণে পরে ৫০ ওভার থেকে কমিয়ে আনা হয় ৪৬ ওভারে এবং তাতে নিউ জিল্যান্ড করে ২৯১ রান। তবে অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট সেভাবে কমেনি, বরং ১৩ ওভার কম খেলে তাঁদেরকে করতে হবে ২৩৫ রান। এর কারণ, বৃষ্টি নামার আগে নিউ জিল্যান্ডের ওভার রিসোর্স মাত্র ৯.৩ ওভার কমেছিল এবং হাতে উইকেট রিসোর্স ছিলো আরো ৯০%। ফলে নিউ জিল্যান্ডের হাতে যথেষ্ট সময় এবং সুযোগ ছিলো পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার, যেটা ডিএল মেথডে নিউ জিল্যান্ডের পক্ষে এসেছিলো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হাতে উইকেট থাকাটা ম্যাটার কেন করছে এখানে?
ধরা যাক এমন একটা সিনারিও, যেখানে ২০ ওভারে কোনো একটা দল ৬ উইকেট হারিয়ে রান করেছে ৮৬ ; আর এরপরই আকাশ ভেঙে নেমেছে বৃষ্টি। এখন ডিএল মেথডে শুরুতে যেটা দেখা হবে, সেটা হচ্ছে রিসোর্স। আর সেখানে দেখা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে সেই দল ওভার রিসোর্স খরচ করে ফেলেছে ৪০ শতাংশ এবং উইকেট হারিয়ে ফেলেছে ৬০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, ডিএল মেথড এটাও বিবেচনায় রাখে যে অনেকগুলোই ছিলো টপ অর্ডার উইকেট। আর সেগুলোতে বেশি ভ্যালু দিয়ে পুনঃনির্ধারণ করা হয় কতগুলো ওভার খেলতে হবে ব্যাটিংরত দলটিকে। আর যাতে করে অমানবিক কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব না হয় দক্ষিণ আফ্রিকার ১ বলে ২২ রানের ঘটনাটির মত, তাই বিবেচনায় রাখা হবে ব্যাটিংরত দলটি কতটুকু সময় পাচ্ছে নতুন করে অ্যাডজাস্ট করার জন্য। ধরুন, সেটা যদি হয় ৩০ ওভার, তাহলে ব্যাটিংরত দলের হাতে উইকেট রিসোর্স থাকবে মাত্র ৪০ শতাংশ (এবং উইকেটগুলো লোয়ার অর্ডার উইকেট!) এবং সেটা নিয়েই সমীকৃত টার্গেট তাড়া করতে হবে পরবর্তী দশ ওভারে। বোঝাই যাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে ভালোমতই বিপদে পড়বে দলটি!
সুতরাং, আমরা যতটুকু শিখতে পারলাম, সেটা হচ্ছে, কোনো একটা ম্যাচে ডিএল মেথড যদি ব্যবহার করতে হয়, তবে মাথায় রাখতে হবে তিনটা ব্যাপারঃ
১. টার্গেটে ব্যাটিং করার সময় দলটি কতটুকু সময় পাচ্ছে অ্যাডজাস্ট করার জন্য,
২. হাতে কতগুলো ওভার রিসোর্স রয়েছে,
৩. বৃষ্টি ম্যাচে বিঘ্ন ঘটানোর মুহুর্তে হাতে কতগুলো উইকেট রিসোর্স রয়েছে।
প্রকাশিত ছক বা টেবিলের মাধ্যমে ডি/এল মেথড বা ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির সর্বশেষ সংস্করণ ২০০৪ সালে বের হয়। এটি পরিস্কারভাবে পূর্বতন নিয়ম-কানুনের তুলনায় একদিবসীয় ক্রিকেটে বেশী রান গড়তে পদ্ধতির উপযোগীতা, গ্রহণযোগ্যতায় রান ও রিসোর্সের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আলোকপাত করেছে। এ পদ্ধতির সর্বশেষ সংস্করণ বৃষ্টিবিঘ্নিত অন্যান্য ঘরোয়া বা অভ্যন্তরীণ খেলাগুলোতেও প্রয়োগ করা হয়।
ডিএল মেথড যথেষ্ট জটিল একটা হিসেব, আর তাতে আপাতত এতটুকু হাতেখড়ি দিয়ে রাখতে আপত্তি থাকার কথা নয়। আর যদি আমাদের নিজেদেরই হিসাব করে ফেলতে ইচ্ছে করে, তবে সকলের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা ভালো, ডাকওয়ার্থ-লুইস ক্যালকুলেটরও অনলাইনে সহজলভ্য। ফলে যেকোনো সময়ে যেকোনো মুহুর্তে সহজেই হিসেব কষে বলে দেওয়া যাবে, বৃষ্টি আইনে কোন দলের ভাগ্য কোনদিকে ঘুরতে যাচ্ছে!
আপনার মতামত লিখুন :